Thursday, 6 May 2021

প্রার্থনা (কবিতা)

সারাংশ কবি বিদ্যাপতি তাঁর পরম আরাধ্য ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে মিনতি করে বলছেন যে চিরস্থায়ী, শাশ্বত ঈশ্বরকে ভুলে তিনি এতদিন মায়াময় সংসারের মোহে আচ্ছন্ন হয়েছি

 

পাঠ – প্রার্থনা (কবিতা)

কবি – বিদ্যাপতি (আনুমানিকঃ ১৩৫২ – ১৪৪৮ খ্রিস্টাব্দ)

প্রার্থনা


সারাংশ

কবি বিদ্যাপতি তাঁর পরম আরাধ্য ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে মিনতি করে বলছেন যে চিরস্থায়ী, শাশ্বত ঈশ্বরকে ভুলে তিনি এতদিন মায়াময় সংসারের মোহে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। উত্তপ্ত বালুকারাশিতে এক বিন্দু জল পতিত হলে তা যেভাবে অস্তিত্বহীন হয় ঠিক সেভাগে এই ক্ষণস্তায়ী সংসারে একান্ত আপনজন সবই অস্তিত্বহীন হয়। সংসারের মোহজালে আবৃত হয়ে তিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ব্যয় করে জীবনকে ব্যর্থতায় পরিণত করেছেন। তাঁর আক্ষেপ এই যে, তাঁর এই ব্যর্থ, মুল্যহীন জীবনের আর কোন প্রয়োজন নেই। ঈশ্বর জগতের ত্রাতা। তিনি দীনের প্রতি দয়াশীল। তাই কবির বিশ্বাস দয়াময় ঈশ্বরের কৃপা ও করুণা থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন না। কবি বলছেন, জীবনের শৈশব ও যৌবনের রঙ্গরসে মজে গিয়ে বার্ধক্যের অনেক সময়ও বৃথায় পার করেছেন। তাঁর জীবনে কৃষ্ণ ভজনের অবকাশ ঘটেনি। সমগ্র সৃষ্টি ঈশ্বরের মধ্যে জন্মে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আবার ঈশ্বরেই বিলীন হয়। কবি বিদ্যাপতি তাই বলছেন, শেষকালে মৃত্যুজনিত ভয় থেকে উদ্ধার পেতে হলে ঈশ্বর ছাড়া আর কোনো গতি নেই। জগতে তিনিই একমাত্র উদ্ধার কর্তা, সুতরাং উদ্ধার করার দায়িত্ব এখন ঈশ্বরের।

প্রার্থনা

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

১। প্রার্থনা কবিতার কবি কে?

উত্তরঃ কবি বিদ্যাপতি।

২। কবি বিদ্যাপতির পিতার নাম কী?

উত্তরঃ গণপতি ঠাকুর।

৩। বিদ্যাপতি প্রকৃতপক্ষে কোথাকার কবি?

উত্তরঃ মিথিলার কবি।

৪। বিদ্যাপতি কোন রাজার সভাকবি ছিলেন?

উত্তরঃ মিথিলার রাজা শিব সিংহের।

৫। বিদ্যাপতি কার বিস্মৃতিতে অনুতপ্ত?

উত্তরঃ শ্রীকৃষ্ণের।

৬। কবি বিদ্যাপতি কার কাছে প্রার্থনা করছেন?

উত্তরঃ ঈশ্বর অর্থাৎ মাধবের কাছে।

৭। এতদিন কবি কীসের মায়ায় আবদ্ধ ছিলেন?

উত্তরঃ সংসারের।

৮। কে দীন দয়াময়?

উত্তরঃ ঈশ্বর।

৯। চতুরানন কাকে বলা হয়েছে?

উত্তরঃ ব্রম্মাকে।

১০। কবি কাকে ভুলেছিলেন বলে অনুতাপ করছেন?

উত্তরঃ শ্রীকৃষ্ণ (মাধব) কে।

১১। ‘বিশোয়াস’ কোন শব্দের অন্তর্গত?

উত্তরঃ ব্রজবুলি।

১২। ‘বিশোয়াস’ শব্দের অর্থ কী?

উত্তরঃ আস্থা বা বিশ্বাস।

১৩। কবি ‘আধ জন্ম’ বলতে কী বুঝিয়েছেন?

উত্তরঃ জীবনের অর্ধেক সময়।

১৪। কবি কোন ভয়েয় কথা বলছেন?

উত্তরঃ শেষকালে মৃত্যুজনিত ভয়ের কথা।

১৫। ব্রজবুলি ভাষায় রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত একটি কাব্যের নাম লেখো।

উত্তরঃ ভানু সিংহের পদাবলী।

১৬। ‘তাতল’ শব্দের অর্থ কী?

উত্তরঃ উত্তপ্ত।

১৭। ‘সৈকত’ শব্দের অর্থ কী?

উত্তরঃ বালু।

১৮। ‘বিসরি’ শব্দের অর্থ কী?

উত্তরঃ বিস্মৃত হয়ে/ভুলে গিয়ে।

১৯। ‘জগ-তারণ’ বলতে কবি বিদ্যাপতি কাকে বুঝিয়েছেন?

উত্তরঃ ঈশ্বর অর্থাৎ মাধবকে।

২০। ‘নিন্দে’ শব্দের অর্থ কী?

উত্তরঃ নিদ্রায়। 

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

১। কবি কাকে ভুলেছিলেন, কেন ভুলেছিলেন?

উত্তরঃ কবি তাঁর পরম আরাধ্য ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে ভুলেছিলেন।

কবি তাঁর একান্ত আপনজন দ্বারা পরিবৃত এই ক্ষণস্থায়ী সংসারে মোহমায়ায় আবদ্ধ ছিলেন। তাই তিনি তাঁর পরম আরাধ্য শ্রীকৃষ্ণকে ভুলেছিলেন।

২। কবি কেন আশাবাদী যে ঈশ্বর তাকে কৃপা করবেন?

উত্তরঃ জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে কবি নিজেকে ঈশ্বরের চরণে সমর্পণ করলেন। তাঁর বিশ্বাস যে তিনি সংসারের মোহে আবদ্ধ হয়ে ঈশ্বরকে ভুলে থাকলেও ঈশ্বর তাকে কৃপা করবেন। কারণ ঈশ্বর জগতের ত্রাতা। তিনি দীনের প্রতি দয়াশীল। তাই কবি আশাবাদী যে জগতে দয়াময় ঈশ্বর তাকে কৃপা ও করুণা থেকে বঞ্চিত করবেন না।

৩। জীবনের অর্ধেক কাল পর্যন্ত কবি কীভাবে সময় অতিবাহিত করেছেন?

উত্তরঃ স্ত্রী, সন্তান, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এই মায়াময় সংসারে কবি ঈশ্বরকে ভুলে গিয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলছেন, জীবনের অর্ধেক সময় তিনি নিদ্রায় অতিবাহিত করেছেন। তিনি শৈশব থেকে বার্ধক্যের গুরায় এসে উপস্থিত হয়ে অনুতপ্ত হয়েছেন।

৪। কবি ঈশ্বরকে কোন কোন নামে সম্বোধন করেছেন?

উত্তরঃ কবি ঈশ্বরকে ‘মাধব’, ‘জগ তারণ’, ‘দীন-দয়াময়’, ‘আদি অনাদি নাথ’ ইত্যাদি নামে সম্বোধন করেছেন।

৫। ‘মাধব’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ লেখো।

উত্তরঃ মাধব শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো পৃথিবীর স্বামী। ‘মাধব’ শব্দে ‘মা’ অর্থাৎ পৃথিবী এবং ‘ধব’ অর্থাৎ স্বামী। 

৬। ব্রজবুলি ভাষা সম্বন্ধে যা যান লেখো।

উত্তরঃ ব্রজবুলি একটি সম্পূর্ণ কৃত্রিম ভাষা। এটি ব্রজ বা বৃন্দাবনের ভাষা নয়। এটি হিন্দি, ওড়িয়া, মৈথিলী, বাংলা ও অসমিয়া শব্দের সঙ্গে গঠিত একটি বিশেষ ভাষা।  

৭। ‘তাতল সৈকত বারিবিন্দুসম’ বলতে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন?

উত্তরঃ ‘তাতল সৈকত বারিবিন্দুসম’ বলতে কবি বোঝাতে চেয়েছেন উত্তপ্ত বালুকা রাশির উপর পতিত জলবিন্দুর মতো মোহময় সংসারের সব ক্ষণস্থায়ী।

৮। কবি কার উপর কেন বিশ্বাস রাখেন?

অথবা

কবি নিজেকে কার চরণে সমর্পণ করেছেন এবং কেন?

উত্তরঃ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কবি নিজেকে ঈশ্বরের চরণে সমর্পণ করেছেন। তিনি ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখেন। কারণ ঈশ্বর জগতের ত্রাতা। তিনি দীনের প্রতি দয়াশীল। তাই দয়াময় ঈশ্বরের চরণে নিজেকে সমর্পণ করলে তিনি অবশ্যই কবিকে সংসারের জাগতিক দুঃখ কষ্ট থেকে উদ্ধার করবেন।

৯। ‘মাধব হাম পরিণাম নিরাশা’। কবির এমন মনোভাবের কারণ কী?

উত্তরঃ আলোচ্য পংক্তিটির মাধ্যমে কবি তাঁর আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন।

কবি এতদিন চিরস্থায়ী শাশ্বত ঈশ্বরকে ভুলে মায়াময় সংসারের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। তাঁর আক্ষেপ তিনি স্ত্রী, পুত্র, মিত্র পরিবৃত হয়ে এতটাই মগ্ন ছিলেন যে তিনি ঈশ্বরকে বিস্মৃত হয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় অতিবাহিত করে জীবনকে ব্যর্থতায় পরিণত করেছেন। তাই কবির এখন মনে হচ্ছে যে ব্যর্থ, মুল্যহীন এই জীবনের আর কোন প্রয়োজন নেই, এর ফলে তার (জীবনের) পরিণাম নিরাশাজনক হবে বলে তিনি শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ মাধবের চরণে দুঃখ প্রকাশ করছেন।

১০। ‘তুয়া বিনু গতি নাহি আরা’ – কেন কবি এমন ভাবছেন?

উত্তরঃ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কবির মনে ভয়ের সঞ্চার হয়েছে এই ভেবে যে মৃত্যু কতই না কষ্টদায়ক। তাই কবি বিদ্যাপতি বলছেন, শেষকালে মৃত্যুজনিত ভয় থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য ঈশ্বর ছাড়া আর কোনো গতি নেই। একমাত্র ঈশ্বরই কবিকে এই ভয় থেকে উদ্ধার করতে পারেন।

১১। প্রার্থনা কবিতায় কবির আক্ষেপ কী?

উত্তর; প্রার্থনা কবিতায় কবি বিদ্যাপতির আক্ষেপ এই যে, তিনি স্ত্রী-পুত্র-মিত্র পরিবৃত হয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি বোঝতে পারেন নি এই মায়াময় সংসারের সবই ক্ষণস্থায়ী। কবির আরও আক্ষেপ, তিনি তাঁর জীবনের অর্ধেক সময় নিদ্রায় কাটিয়ে দিয়াছেন। তিনি শৈশব থেকে বার্ধক্যের জরাগ্রস্ততায় এসে উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তাঁর ঈশ্বরের নাম নেওয়ার অবকাশ ঘটেনি। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় অতিবাহিত করে জীবনকে ব্যর্থতায় পরিণত করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁর এখন মনে হচ্ছে এই ব্যর্থ ও মুল্যহীন জীবনের আর কোন প্রয়োজন নেই।

১২। নিধুবন কোন স্থানে অবস্থিত এবং কেন বিখ্যাত?

উত্তরঃ নিধুবন বৃন্দাবনে অবস্থিত একটি বন। এটি রাধাকৃষ্ণের প্রমোদ বিহারের উদ্যান। এখানে রাধাকৃষ্ণ ক্রীড়াকৌতুক ও আমোদ প্রমোদে সময় অতিবাহিত করেছেন বলেই এই বন বিখ্যাত।

দীর্ঘ উত্তরীয় প্রশ্নঃ

প্রঃ ‘প্রার্থনা’ কবিতাটির অবলম্বনে কবির বক্তব্য বিষয় পরিস্ফুট করো।

উত্তরঃ ‘প্রার্থনা’ কবিতায় কবি তাঁর পরম আরাধ্য শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ মাধবের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে সমর্পণ করেছেন। কবির আক্ষেপ তিনি, তিনি এতদিন স্ত্রী, বন্ধুবান্ধব নিয়ে এই মায়াময় সংসারের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে চিরস্থায়ী ও শাশ্বত ঈশ্বরকে ভুলে গিয়েছিলেন। আজ তিনি উপলব্ধি করছেন যে উত্তপ্ত বালুকারাশিতে একবিন্দু জল পতিত হলে যেভাবে বিলীন হয়ে যায় ঠিক সেইভাবে এই ক্ষণস্থায়ী সংসারের সব বিলীন হয়ে যায়। সংসারের মোহে তিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ব্যয় করে জীবনকে ব্যর্থতায় পূর্ণ করেছেন। তাই তাঁর আক্ষেপ এই যে, ব্যর্থ ও মুল্যহীন এই জীবনের আর কোন গুরুত্ব নেই। ঈশ্বর জগতের ত্রাতা এবং দীনের প্রতি দয়াশীল। তাই কবির বিশ্বাস জগতের পরিত্রাতা দীন-দয়াল ঈশ্বরের কৃপা ও করুণা থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন না। এখন তিনি সবকিছু ভুলে ঈশ্বরের চরণে নিজেকে সমর্পণ করে আক্ষেপ করছেন এই বলে যে তাঁর অর্ধেক জীবন কেটেছে নিদ্রায়। তিনি শৈশব পার হয়ে এখন বার্ধক্যের জরাগ্রস্ত অবস্থায় এসে উপস্থিত হয়েছেন। যৌবনে তিনি রঙ্গরসে মেতেছেন। তাই তিনি ঈশ্বর ভজনের সময় পাননি। তিনি ঈশ্বরের বন্দনা করে বলছেন, কত ব্রম্মার মৃত্যু হচ্ছে কিন্তু ঈশ্বরের কোনো অবসান নেই। তাঁর মধ্যে সবার জন্ম হয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তাঁর কৃপায় সবই তাঁর মধ্যে বিলীন হয়। তাই কবি বলছেন যে, শেষকালে মৃত্যুজনিত ভয় থেকে উদ্ধার করবার জন্য ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ নেই। কারণ তিনিই জগতে একমাত্র উদ্ধারকর্তা। সুতরাং উদ্ধার করবার দায়িত্ব এখন ঈশ্বরের অর্থাৎ মাধবের।

প্রঃ ‘সাগর-লহরী সমানা’ – উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

উত্তরঃ আলোচ্য উক্তিটি কবি বিদ্যাপতি রচিত ‘প্রার্থনা’ কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। উক্ত উক্তিটির মাধ্যমে কবি ঈশ্বরের মহিমার গুণকীর্তন করেছেন।

এখানে কবি বিদ্যাপতি বোঝাতে চেয়েছেন যে সমুদ্রের ঢেউ যেভাবে সমুদ্রের মধ্যে উৎপত্তি হয়ে আবার তা সমুদ্রেই বিলীন হয় ঠিক সেভাবে ঈশ্বর অর্থাৎ পরমাত্মা থেকে অগণিত জীবাত্মার সৃষ্টি হয়ে আবার সে সব জীবাত্মা ঈশ্বরের কৃপায় মুক্তি লাভ করে ঈশ্বরেই বিলীন হয়। কবি এই উক্তিটির মাধ্যমে ঈশ্বরের স্বরূপ বর্ণনা করেছেন। খানে তিনি সমুদ্রের স্বরূপের সঙ্গে পরমাত্মা এবং সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে জীবত্মার তুলনা করেছেন।

প্রঃ ‘প্রার্থনা কবিতার কবি বিদ্যাপতির পরিচয় দাউ অথবা টীকা লেখো।

উত্তরঃ বিদ্যাপতি ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে মিথিলার এক বিদগ্ধ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বৈষ্ণব পদাবলী ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হলেন বিদ্যাপতি। তাঁর পিতার নাম গণপতি ঠাকুর। তিনি মিথিলার রাজা শিব সিংহের সভাকবি ছিলেন। মিথিলার কবি হলেও বাংলা কাব্য সাহত্যের ভাণ্ডারকে তিনি নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর রচিত পদগুলি বাংলা সাহিত্যের অমুল্য সম্পদ। সংস্কৃত সাহিত্যেও তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। ১৪৪৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরলোক গমন করেন।

  

দীর্ঘ উত্তরীয় প্রশ্নঃ

প্রঃ ‘প্রার্থনা’ কবিতায় কবি যেভাবে আত্মবিশ্লেষণ করেছেন তা বর্ণনা করো।

উত্তরঃ ‘প্রার্থনা’ কবিতায় কবি বিদ্যাপতি তাঁর মানব জীবনকে ঈশ্বরের চরণে সমর্পণ করেছেন। আলোচ্য কবিতায় তিনি নানাভাবে আত্মবিশ্লেষণ করেছেন। কবি আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে তাঁর জীবনের ব্যর্থতার কথা ব্যক্ত করেছেন। যেমন তিনি আক্ষেপ করেছেন যে তিনি স্ত্রী-পুত্র, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ক্ষণস্থায়ী সংসারের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে ঈশ্বর ভজনা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কারণ জীবনের অর্ধেক সময় তিনি নিদ্রায় কাটিয়েছেন। শৈশব থেকে শুরু করে এখন বার্ধক্যের জরাগ্রস্থতায় এসে উপস্থিত হয়েছেন। যৌবনে রসরঙ্গে মেতে ছিলেন। আবার তিনি যখন নিজেকে দীন বলে ভেবেছেন তিখন তাঁর মনে হয়েছে ঈশ্বর দীনের প্রতি দয়াশীল তাই ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করলে তিনি অবশ্যই ঈশ্বরের কৃপা ও করুণা লাভ করবেন। জীবনের অন্তিম সময়ে মৃত্যুজনিত ভয় থেকে অবশ্যই ঈশ্বর তাকে রক্ষা করবেন। তাই তিনি সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরের চরণে নিজেকে সমর্পণ করছেন। এইভাবে কবিতায় কবি আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে ঈশ্বরের মহিমা এবং ঈশ্বরের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ব্যক্ত করেছেন।

 

প্রঃ ‘মাধব হাম পরিণাম নিরাশা’, কার কোন রচনা থেকে পঙক্তিটি উদ্ধৃত করা হয়েছে? মাধব বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? কবির এই মন্তব্যের যথার্থতা আলোচনা করো।

উত্তরঃ পঙক্তিটি কবি বিদ্যাপতি রচিত ‘প্রার্থনা’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

মাধব বলতে শ্রীকৃষ্ণকে বোঝানো হয়েছে। কবি বিদ্যাপতি কবিতায় তাঁর পরম আরাধ্য শ্রীকৃষ্ণকে ‘মাধব’ বলে সম্বোধন করেছেন।

কবি বিদ্যাপতি মিনতি করে বলেছেন যে, চিরস্থায়ী ও শাশ্বত ঈশ্বরকে ভুলে তিনি এতদিন স্ত্রী, সন্তান ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে মায়াময় সংসারের মোহে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু আজ তিনি বোঝতে পারছেন যে এ সবই উত্তপ্ত বালুকারাশিতে পতিত একবিন্দু জলের মতো, যা নিমিষেই বিলীন হয়ে যায় অর্থাৎ এই মায়াময় সংসার ক্ষণস্থায়ী। তাই তিনি ঈশ্বর ভজনা না করে জীবনকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেচেন। ফলে এর পরিণাম নিরাশাজনক হবে বলে তিনি শ্রীকৃষ্ণপদে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

 

প্রঃ ‘প্রার্থনা’ কবিতায় কবির আক্ষেপ কী? সেখান থেকে উত্তরণের কী পথ নিয়েছেন?

অথবা

‘প্রার্থনা’ কবিতায় কবি কী প্রার্থনা করলেন?

অথবা

‘প্রার্থনা’ কবিতার সারমর্ম লেখো।

উত্তরঃ ‘প্রার্থনা’ কবিতায় কবি বিদ্যাপতির আক্ষেপ এই যে, তিনি স্ত্রী-পুত্র-মিত্র পরিবৃত হয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি বোঝতে পারেন নি এই মায়াময় সংসারের সব ক্ষণস্থায়ী। কবির আরও আক্ষেপ, তিনি তাঁর জীবনের অর্ধেক সময় নিদ্রায় কাটিয়ে দিয়েছেন, তিনি শৈশব থেকে বার্ধক্যের জরাগ্রস্থতায় এসে উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তাঁর ঈশ্বরের নাম নেওয়ার অবকাশ ঘটে নি। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় অতিবাহিত করে জীবনকে ব্যর্থতায় পরিণত করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁর এখন মনে হচ্ছে এই ব্যর্থ ও মুল্যহীন জীবনের আর কোন প্রয়োজন নেই।

কিন্তু আজ তিনি নিজেকে ঈশ্বর অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের চরণে সমর্পণ করেছেন। কারণ তিনি জানেন শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া তাকে উদ্ধার করার মতো আর কেউ নেই। ঈশ্বর জগতের ত্রাতা। তিনি দীনের প্রতি দয়াশীল। তাই তাঁর মতো দীনকে মৃত্যুজনিত ভয় থেকে একমাত্র ঈশ্বরই উদ্ধার করতে পারবেন। এই মৃত্যুজনিত ভয় থেকে পরিত্রাণ পেতে তিনি ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখছেন।

 

প্রঃ ‘প্রার্থনা’ কবিতার নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।

উত্তরঃ বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে মানব জীবনকে ঈশ্বরের চরণে সমর্পণ করার প্রয়াস নিয়ে যে পদগুলি রচিত, সেই পদগুলি ‘প্রার্থনা’ বিষয়ক পদের অন্তর্ভুক্ত। আলোচ্য কবিতাটিতে কবি বিদ্যাপতি মাধবের চরণে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। জীবনের অনেক মুল্যবান সময় মায়াময়, ক্ষণস্থায়ী সংসারের মোহে ডুবে থেকে তিনি ভগবৎ চিন্তা না করে কাটিয়ে দিয়েছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে তিনি জীবনের আসল উদ্দেশ্য বোঝতে পেরেছেন। তাই আলোচ্য কবিতাটিতে কবি বিদ্যাপতির প্রার্থনাই মূলত প্রাধান্য পেয়েছে। সুতরাং, এই পদটি ‘প্রার্থনা’ বিষয়ক পদ। তাই আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে আলোচ্য কবিতাটির নামকরণ যথার্থ সার্থক হয়েছে।  

  

ক্রিয়াকলাপঃ

প্রঃ শূন্যস্থান পূর্ণ করো;

ক) তাতল ____ বারিবিন্দুসম।

উত্তরঃ সৈকত

খ) মাধব ____ পরিণাম নিরাশা।

উত্তরঃ হাম।

গ) ____ জগতারণ, দীন দয়াময়।

উত্তরঃ তুহুঁ।

ঘ) আধ জনম হাম নিন্দে ____

উত্তরঃ গোঙায়লুঁ।

ঙ) ____ রমণী রসরঙ্গে মাতলু।

উত্তরঃ নিধুবনে।

প্রঃ পাঠ অনুসরণে শুদ্ধ করে লেখঃ

ক) সূত-মিত পুরুষ সমাজে।

উত্তরঃ সূত-মিত রমণী সমাজে।

খ) তুহুঁ জগন্নাথ দীন দয়াময়।

উত্তরঃ তুহুঁ জগ-তারণ দীন দয়াময়।

 পাঠভিত্তিক ব্যাকরণঃ  

প্রঃ ‘প্রার্থনা’ কবিতা থেকে কয়েকটি ব্রজবুলি শব্দের উল্লেখ করো।

উত্তরঃ বিসরি, তুহুঁ, বিশোয়াসা, যাওত, তুয়া, সগর, তোহে, ভণয়ে, আরা, কহায়সি।

 প্রঃ প্রার্থনা কবিতায় উল্লেখিত সর্বনাম পদগুলি লেখো।

উত্তরঃ তোহে, তুই, হাম, তুয়া।

 প্রঃ নিচের শব্দগুলির গদ্যরূপ লেখো।

সমর্পিলু, অব, জনম, নিন্দে, মাতলু, ভজব

উত্তরঃ সমর্পিলু – সমর্পণ করলাম ।   অব – এখন ।      জনম – জন্ম।      নিন্দে – নিদ্রায়।

মাতলু – মাতালাম।      ভজব – ভজনা করব।

প্রঃ পদ পরিবর্তন করো।

সমাজ, শিশু, জন্ম, মন, বিধি

উত্তরঃ সমাজ – সামাজিক।     শিশু – শৈশব।     জন্ম – জন্মান্তর, জাত।   মন – মানসিক।

বিধি – বিধান।

 

প্রঃ বিশিষ্টার্থক শব্দ প্রয়োগে অর্থপূর্ণ বাক্য রচনা করো।

গোবরে পদ্মফুল,   খয়ের খাঁ,   চোখের বালি,      টনক নড়া,         ঠোট কাটা

উত্তরঃ গোবরে পদ্মফুল (নীচ কূলে প্রতিভাবান ব্যক্তির জন্ম) – একজন ঠেলাচালকের ঘরে জন্মেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে, এ যেন গোবরে পদ্মফুল।

খয়ের খাঁ ( তোষামোদকারী) – খয়ের খাঁয়ে পরিণত লোকরা অপরের লোকসান কখনও বোঝে না।

চোখের বালি ( সহ্য করতে না পারা) – বিমলের কাছে পাড়ার ছেলেরা যেন চোখের বালি।

টনক নড়া ( আচমকা জ্ঞানোদয়) – ঈশ্বর ভজনে জীবনের শেষকালে দেখি তোমার টনক নড়ল।

ঠোট কাটা ( স্পষ্ট কথা বলা) ঠোট কাটা লোকরাই সর্বদা সত্যতার প্রতি আগ্রহ দেখায়।

 


Rajesh Konwar

Author & Editor

Has laoreet percipitur ad. Vide interesset in mei, no his legimus verterem. Et nostrum imperdiet appellantur usu, mnesarchum referrentur id vim.

0 comments:

Post a Comment