আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে, আসে নাই কেহ অবনি পরে। সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
পৃথিবীতে কোনো মানুষই চিরস্থায়ী নয়। মানুষ কেবল চিরস্থায়ী থাকতে পারে তার মহৎ কর্মের মাধ্যমে। মানুষের যথার্থ পরিচয় নিহিত কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার মাধ্যমে। যারা শুধু নিজের সুখ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তারা প্রকৃত সুখের সন্ধান পায় না। জীবনে কেউ যদি ভালো কাজ না করে তবে সে জীবন অর্থহীন। মানবজীবন শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। কারণ ব্যক্তিস্বার্থের ক্ষুদ্র পরিসরে মানবস্বার্থের চিন্তার অবকাশ থাকে না। অন্যের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে কাজ করার মধ্যেই আত্মা প্রকৃত অর্থে সুখী হয়। মানুষ সুখের জন্য দিশেহারা, তারা কাজের মধ্যে সুখ খুঁজে পেতে চায়। তাই মানুষের প্রতি স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা হারিয়ে ফেলে। অপরদিকে পৃথিবীতে কম সংখ্যক মানুষ আছে যারা নিজের কথা চিন্তা না করে, অন্যের সুখ-শান্তি তথা কল্যাণের কথা চিন্তা করে। অপরের সুখ-শান্তির মাঝে নিজের পরম সুখের ঠিকানা খুঁজে পায়। বিশ্বের যা কিছু মহান, মহৎ কর্ম, যা মানব সভ্যতাকে স্বর্ণ শিখরে নিয়ে গেছে তার মূলে রয়েছে মহৎ মানুষের ভূমিকা। অপরের কল্যাণ সাধনের জন্য তারা তাদের নিজেদের সুখ শান্তি, আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস সবকিছু বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করেননি।
শিক্ষা: মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াই প্রকৃত মানুষের কাজ।
এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
বেঁচে থাকার তাগিদে অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু সমাজের এক শ্রেণির মানুষ যাবতীয় অর্থসম্পদ নিজেদের কুক্ষীগত করতে সদা সচেষ্ট। তাদের এই বিকৃত লোভের শিকার হয় দরিদ্র ও অসহায় মানুষেরা। প্রাচীনকাল থেকেই এই ধারা প্রচলিত হয়ে আসছে। জমিদাররা যেমন বিপুল সম্পদের মালিক হয়েও সামান্য খাজনার জন্য দরিদ্র প্রজার সহায়-সম্বলটুকু কেড়ে নিতে কুণ্ঠিতবোধ করতো না, তেমনি বর্তমানেও ক্ষমতাপিপাসু একটা শ্রেণি নিজেদের জন্য সম্পদ আহরণের নেশায় মত্ত হয়ে নিজেদের মানবতাকে বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না। তারা সমাজের দরিদ্র শ্রেণির মানুষদের অধিকারবঞ্চিত করে নিজেদের সম্পদের পাহাড় বানিয়ে চলে ক্রমাগত। কেননা তাদের আরো সম্পদ, আরো ভোগ-বিলাসিতার প্রয়োজন। বিত্তবানদের এই ধরণের বিকৃত অর্থলিপ্সার কোনো সীমা নেই বরং দিনে দিনে তাদের লালসা বাড়তেই থাকে। অঢেল সম্পদের মালিক হয়েও, আরো পাওয়ার ইচ্ছা তাদেরকে অমানুষে পরিণত করে। নিজেদের সম্পদ আরো বাড়িয়ে তোলার নেশায় তারা ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সাদা-কালো কোনো কিছুই বাছ-বিচার করে দেখে না। এমনকী অর্থলিপ্সায় কাতর এই বিত্তবান লোকগুলো গরিবের মুখের অন্ন, মাথা গোঁজার নিরাপদ আশ্রয়, ন্যূনতম শিক্ষা প্রভৃতি মৌলিক অধিকারগুলো হরণ করে নিজেদের সম্পদের পাহাড় আকাশচুম্বী করে তোলে। আর এভাবেই সমাজে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বাড়তে থাকে। দরিদ্রের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে ধনীরা হয় আরো ধনী, অন্যদিকে যারা দরিদ্র তারা আরো বেশি দরিদ্র হয়ে পড়ে। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান না দিতে পেরে তারা অনাহারে-অর্ধাহারে, বস্তির ঘুপচি ঘরে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়।
শিক্ষা: এ পৃথিবীতে গরিবদেরও বাঁচার অধিকার আছে। পুঁজিবাদী বিত্তবানদের উচিত গরিবের সম্পদ আত্মসাৎ করে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধির নিলর্জ্জ মোহ পরিহার করা এবং তাদের দিকে সাহায্য, সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেয়া।
সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
প্রতিটি সমাজেই কিছু আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর মানুষ বাস করে। তারা সমাজের প্রতি দায়িত্ব ভুলে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। সামাজিক জীব হিসেবে সমাজ এবং সমাজের সদস্যদের প্রতি প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে। সমাজবদ্ধভাবে বসবাসের মধ্য দিয়েই মানুষ সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে এই সমাজ। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে যেমন সমাজের অবদান রয়েছে তেমনি সমাজের প্রতিও রয়েছে আমাদের দায়িত্ব। সমাজবদ্ধভাবে বাস করতে হলে ব্যক্তিস্বার্থের চিন্তা পরিহার করে চলতে হয়। স্বার্থবাদী চিন্তা নিয়ে সমাজের উন্নয়ন যেমন সম্ভব না তেমনি ব্যক্তি জীবনেও সাফল্য আসে না। সমাজের অন্য সদস্যরা যাতে ব্যক্তিস্বার্থের সংকীর্ণতার শিকার হয়ে কষ্ট না পায় সেটাই হওয়া উচিত সব মানুষের কামনা। আর এর জন্য প্রয়োজন স্বীয় স্বার্থ ত্যাগ করা। কারণ অন্যের উপকারে উৎসর্গিত জীবনই প্রকৃত জীবন। পরোপকারী মানুষ অমর এবং সর্বজন পূজনীয় হয়। বিবেক এবং চিন্তার শক্তিই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে। সুতরাং বিবেকবান কোনো মানুষই নিজের স্বার্থের কথা ভেবে সমাজ এবং চারপাশের মানুষের প্রতি তার দায়িত্ব ভুলে যেতে পারে না। সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে তাহলে সমাজ হয়ে উঠবে সুন্দর।
শিক্ষা: ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে মানবতার স্বার্থে নিয়োজিত হওয়ার মধ্যেই মানবজীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত।
শৈবাল দীঘিরে বলে উচ্চ করি শির লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির।
মহৎ মানুষ হিংসা, হীনতা ও স্বার্থপরতা থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। তাদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও কর্ম দিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণসাধন করেন। তারা কখনো আপন গৌরবের কথা, উপকারের কথা অন্যের কাছে গর্ব করে প্রচার করেন না। সমাজের মানুষকে তারা বটবৃক্ষ হয়ে আগলে রাখেন। তারা নিঃস্বার্থভাবে অপরের জন্য কাজ করে যান। বিপরীতে আমাদের সমাজে কিছু হীন, স্বার্থপর মানুষ আছে যারা কখনো যদি উপকারীর সামান্যতম উপকার করতে পারে, তবে তা অতিরঞ্জিত করে প্রচার করে। তারা কখনোই বুঝতে চেষ্টা করে না যে তারা কতটা ক্ষুদ্রমনা। এই অকৃতজ্ঞতাবোধের পরিচয় পাওয়া যায় শৈবালের জীবনে। শৈবালের জন্ম দিঘীর জলে, দিঘীর জলেই তার অবস্থান। দিঘী তাকে পরম মমতায় তার জলে স্থান দেয়। সেই জলেই শৈবালের বেড়ে ওঠা। শৈবালের উচিত দিঘীর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। কিন্তু তা না করে মিথ্যে বাহাদুরি দেখায়। কেননা, শৈবালের ডগায় রাতের শিশির বিন্দু জমে। এক সময় তা দীঘির জলে পড়ে। অকৃতজ্ঞ শৈবাল তখন অহংকার করে বলে যে, সে দীঘিকে এক ফোঁটা জল দিয়েছে। তার এই এক ফোঁটা জল নিতান্তই তুচ্ছ যা দীঘির তেমন কোনো উপকারে আসে না। বরং এতে শৈবালের হীনমন্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। আমাদের সমাজের অকৃতজ্ঞ মানুষগুলোও শৈবালের মতোই।
শিক্ষা: মহৎ তারাই যারা মিথ্যে বাহাদুরির আশ্রয় নেন না। পরের কল্যাণ সাধনেই তাদের সুখ।
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। চারপাশের জীব-জগৎ নিয়েই মানুষ জীবনযাপন করে। প্রত্যেক জীবের সাথে অন্য জীবের কোনো না কোনোভাবে সম্পর্ক রয়েছে। জ্ঞান-বুদ্ধির অধিকারী মানুষও সেই সম্পর্ক বা বন্ধনে আবদ্ধ। যে সৃষ্টিকর্তা তাকে এই সুন্দর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন মানুষের কর্তব্য তাঁর উপাসনা করা, তাঁকে খুশি করা। মানুষ তাঁকে খুশি করতে পারে তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবেসে সেবা করে। স্রষ্টার সৃষ্টিকে না ভালোবেসে, মসজিদ-মন্দিরে গিয়ে যদি আমরা সারা দিন রাত তাঁকে ডাকি তিনি খুশি হবেন না। কেননা, সৃষ্টিকর্তা সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন পরম ভালোবেসে। ক্ষুদ্র থেকে বিশাল সবকিছুর প্রতিই তাঁর দৃষ্টি রয়েছে। আর সব কিছু তিনিই লালন-পালন করছেন। তাই তাঁর সৃষ্টির সেবার মাঝেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে, সংসার ত্যাগী হয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে তাঁকে খুঁজলে পাওয়া যায় না। আমাদের সমাজে যারা ঐশ্বর্যশালী মানুষ তাদের উচিত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এতে অসহায় মানুষগুলো খুশি হবে। মানুষের এই খুশিই সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করবে। সমাজ হবে সুন্দর। শুধু মানুষ নয়, পশু পাখিকেও ভালোবাসতে হবে। তাকে পেতে হলে জীবে দয়া করতে হবে। তাইতো সব ধর্মের মূল কথা জীবে দয়া করা। সর্বোপরি সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টার বহিঃপ্রকাশ। তাই ঈশ্বরকে সেবা করতে হলে তাঁর সৃষ্টিকেই সেবা করতে হবে।
শিক্ষা: সৃষ্টিবিহীন যেমন স্রষ্টার কথা ভাবা যায় না, ঠিক তেমনি সৃষ্টিকে বাদ দিয়ে স্রষ্টাকে খোঁজা বৃথা চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে তিনি মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।
পৃথিবী অজস্র মানুষের সমারোহে প্রাণচঞ্চল। এ সব মানুষের ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস, অভ্যাস পৃথক। কিন্তু চাল-চলন, আচার ব্যবহারে সমগ্র মানবসমাজকে তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায় - উত্তম, মধ্যম, অধম। এদের শ্রেণি, চরিত্র ভিন্নতর অভিধায় চিহ্নিত। উত্তম সকল ক্ষেত্রেই উৎকৃষ্ট। সকলের উপর তার অবস্থান। অধম সকল ক্ষেত্রেই নিকৃষ্ট। সকলের নিচে তার অবস্থান। এই দুই শ্রেণি সম্পর্কে সমাজ স্পষ্ট ধারণা পোষণ করে। এই দুয়ের মধ্যবর্তী মধ্যম শ্রেণিকে নিয়েই সমস্যা। মানুষ এ শ্রেণিকে নিয়েই ভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। তাই সমাজ, তাদের ব্যাপারে সদা সতর্ক। উত্তমকে নিয়ে কারো কোনো ভয় বা শঙ্কা নেই। কারণ তার দ্বারা কোনো অকল্যাণ সাধিত হয় না। পাপ-পঙ্কিলতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। চরিত্রগুণে সে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করে। তাই সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে তাঁর সহজ অবস্থান লক্ষণীয়। অধমের ক্ষেত্রেও মানুষ একইভাবে শঙ্কামুক্ত। কারণ সমাজ তার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করে না। তার অসৎ চরিত্র, খারাপ মনোবাসনা, মন্দ কাজ সম্পর্কে সকলেই জ্ঞাত। কিন্তু মধ্যম শ্রেণি নিয়ে সবাই সব সময় সংশয়াপন্ন। মধ্যম নিজ শ্রেণি থেকে অধমে রূপান্তরিত হয় না, আবার উত্তমে ও উত্তরণ ঘটাতে অক্ষম। শ্রেণিচ্যুতির আশঙ্কায় সতর্ক পদক্ষেপে তার অভিযাত্রা। দুর্বল মানসিকতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, এ অভিযাত্রার সঙ্গী। প্রয়োজনে সে নিকৃষ্ট কাজ করে। আবার প্রয়োজনে কখনো কখনো ভালো কাজেও তার সরব উপস্থিতি। প্রকৃত পক্ষে এ শ্রেণি সুবিধাবাদী হবার ফলে জনসাধারণের প্রতারিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। বিশ্ব সমাজে ছদ্মবেশধারীর মতোই তার আচরণ। এ ধরণের শ্রেণি চরিত্রের কারণে অধম থেকে সে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে, উত্তমের সঙ্গেও প্রাণখুলে হাসতে, মেলামেশা করতে পারে না।
শিক্ষা: জীবনে সফলতা অর্জন করতে হলে মধ্যবিত্ত মানসিকতা পরিহার করতে হবে।
কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে?
পদ্মকে তুলতে গিয়ে কাঁটার ভয় করলে চলবে না। কাঁটার ভয়ে বা কাঁটার আঘাতে যদি কেউ পদ্ম তুলতে না যায়, তাহলে তার পক্ষে পদ্ম আহরণ সম্ভব হবে না। তেমনি দুঃখকে বাদ দিয়ে জীবনে সুখের আশা করা যায় না। একটিকে চাইতে গেলে অপরটিকে মেনে নিতে হয়। ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ জয়-পরাজয় ইত্যাদি নিয়েই আমাদের জীবন। একটি অপরটির পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। দুঃখকে বাদ দিলে জীবনে সুখের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। দুঃখের মধ্য দিয়েই জীবনে সুখের আস্বাদ লাভ করা যায়। সফলতার পথ কণ্টকাকীর্ণ। এই কাঁটার ভয়ে যে সেই পথে হাঁটে না সে কখনো সফল হয় না। দুঃখ-যন্ত্রণা, পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়েই মানুষ তার গন্তব্যে পৌঁছায়। আর যারা দুঃখ-যন্ত্রণা, ক্লান্তির ভয়ে ভীত হয় তারা সহজেই ঝরে পড়ে সাফল্যের পথ থেকে। তাই সকল প্রতিকূলতাকে বরণ করেই মানুষকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। পৃথিবীতে যাঁরা বড় হয়েছেন, সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছেন তাঁরা সবাই সাধনার দ্বারা দুঃখ-কষ্ট, বাধা-বিঘ্নকে অতিক্রম করেই হয়েছেন। পরাজয়ের গ্লানি, পরিশ্রমের কষ্টকে জয় করার মাধ্যমেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন- “ব্যর্থতাই মানুষের জীবনের প্রথম সাফল্য।”
শিক্ষা: জীবনকে সাফল্যমন্ডিত করতে হলে সকল দুঃখ-কষ্ট, বাধা-বিঘ্ন জয় করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ কষ্টের মাধ্যমে অর্জিত সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।
সুন্দর সমাজ গড়ার জন্য এবং সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মানুষ গড়ে তুলেছে অনুশাসন এবং ন্যায়-নীতি। কিন্তু কিছু মানুষ রয়েছে যারা এসব ন্যায়-নীতি অমান্য করে অন্যায় ও অবৈধ কর্মতৎপরতায় লিপ্ত হয়। এরা সমাজের চোখে অন্যায়কারী এবং আইনের চোখে অপরাধী হিসাবে বিবেচিত। আবার যারা অন্যায়ের প্রতিবিধান বা বিরুদ্ধাচরণ করে না বরং শৈথিল্যের সাথে তা মেনে নেয়, সূক্ষ্ম বিচারে তারাও অপরাধী। কারণ অন্যায়ের বিচার না করলে তা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। বিবেকবান মানুষ হিসাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার চেতনার অধিকারী হলেও অনেক সময় মানুষ নানা কারণে দিনের পর দিন অন্যায়কে সহ্য করে। সরাসরি অন্যায় না হলেও এটি অন্যায়কে সহযোগিতা করার নামান্তর। অনেকে বিপদের ঝুঁকি থাকায় নীরবে অন্যায়কে সহ্য করে চলে। এসব প্রবণতার কারণে আজ আমাদের সমাজে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে অন্যায়কারী এবং অন্যায় সহ্যকারী উভয়ই সম অপরাধে অপরাধী।
শিক্ষা: শুধুমাত্র নিজে অপরাধ না করলে সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। সমাজের বিবেকবান ও সচেতন মানুষ হিসাবে আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তাহলে আমরা দুর্নীতিমুক্ত সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।
কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই বলে ডাক যদি দেব গলা টিপে, হেন কালে আকাশেতে উঠিলেন চাঁদা, কেরোসিন শিখা বলে- “এসো মোর দাদা।”
মানুষ ভেদে চরিত্রে পার্থক্য থাকলেও পৃথিবীর সব মানুষের চরিত্র কিছু বৈশিষ্ট্যে সাদৃশ্যপূর্ণ। মানব চরিত্রের তেমনি একটি বৈশিষ্ট্যকে কেরোসিন শিখার মাধ্যমে রূপায়ণ করা হয়েছে। মানুষ অর্থ-বিত্ত, সামাজিক পদমর্যাদা ইত্যাদির স্বপ্নে বিভোর হয়ে কখনও কখনও নিজের অতি আপনজনকেও চিনতে পারে না। মানুষ যখন সমাজে উচ্চ অবস্থান অর্জন করে তখন সে তার আপন মানুষজন আত্মীয় স্বজনকে অবহেলা করে। অবহেলাই কোনো কোনো সময় অস্বীকারে রূপ নেয়। মানুষ তখন তার দরিদ্র আপনজনদের আর স্বীকৃতি দিতে চায় না। অথচ এই মানুষটিই আবার তার চেয়ে উচ্চ পদস্থ কারও তোষামোদ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। যেখানে নিজের দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনদের যে স্বীকার করতেও কুন্ঠাবোধ করে সেখানে দূরের একজন উচ্চ-পদস্থ ব্যক্তির সাথে সে জোর করে কাল্পনিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে। সে মনে করে এতে সে সামাজিকভাবে আরও মর্যাদা পাবে, এবং অন্যরা তাকে আরও সমাদর করবে। এভাবে সে নিজেকে প্রচার করে গর্ববোধ করে। মূলত মানুষ নিজের চেয়ে অবস্থানে ছোটদের চরমভাবে অস্বীকার করে, আর বড়দের তোষামদ করে আপন করে নিতে চায়।
শিক্ষা: পদমর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান মানুষকে অন্ধ করে দেয়।
সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।
মানুষ চাইলেই একা থাকতে পারে না। সমাজে বসবাস করতে হলে সব ধরণের মানুষের সাথে চলাফেরা করতে হয়। সেখানে ভালো মানুষ যেমন আছে তেমনি খারাপ মানুষও আছে। তবে জন্মগত ভাবে মানুষ খারাপ হয় না। পরিবেশ, পরিস্থিতি, আর সঙ্গী সাথীর কারণে মানুষের চরিত্র কলঙ্কিত হয়। তাই বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে। জীবনকে সুন্দর ও অর্থবহ করে তুলতে পারে সৎ সঙ্গ। তাই সৎ সঙ্গ সবাই কামনা করে। সৎ সঙ্গের বিপরীত হচ্ছে অসৎ সঙ্গ। যাদের মাধ্যমে কখনই ভালো কিছু আশা করা যায় না। সৎ সঙ্গীর পরামর্শ অনেক সাফল্য এনে দিতে পারলেও অসৎ সঙ্গীর পরামর্শ জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। একজন মানুষ ভালো কি মন্দ তা বোঝা যায় তার বন্ধু নির্বাচনের মাধ্যমে। অসৎ সঙ্গীর কারণে ভালো মানুষও একসময় বিপথে চলে যায়। অন্যদিকে সৎ সঙ্গ জীবনকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলে। মানুষ যখন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না তখন একজন ভালো বন্ধু সৎ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারে। কোনো মানুষের আচরণ, চরিত্র কেমন হবে সেটা বোঝা যায় তার সঙ্গী-সাথী দেখে। মানুষ তার সঙ্গী দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত হয়। ভালো মানুষের সঙ্গ খারাপ ব্যক্তিকেও ভালো করে, আবার খারাপ মানুষের সংস্পর্শে ভালো মানুষও ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে উঠে।
শিক্ষা: জীবনকে সুন্দর করতে চাইলে সৎ সঙ্গী গ্রহণ, আর অসৎ সঙ্গী বর্জন করতে হবে।
0 comments:
Post a Comment