বন্যেরা বনে সন্দর; শিশুরা মাতৃক্রোড়ে
সৃষ্টিজগতে সবকিছুই নিজ নিজ পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতায় স্বাভাবিক সৌন্দর্যে অনুপমতা পায়। পরিবেশের সঙ্গে থাকে তার স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ সম্পর্ক। পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যের অনুষঙ্গেই বিকশিত হয় তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য।
মানব জীবনে পরিবেশের প্রভাব অসামান্য। বিচিত্র পরিবেশ মানব জীবনে ফেলেছে বৈচিত্র্যময় প্রভাব। অরণ্যচারী মানুষ অরণ্যক জীবনেই পায় স্বতঃস্ফূর্ত স্বাচ্ছন্দ। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজস্ব পন্থায় তারা প্রকৃতির সঙ্গে জীবন-সম্পর্ক গড়ে তোলে। অরণ্যলালিত সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনেই তারা পরিতৃপ্ত। প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে হয় মানানসই। আলো-ঝলমল নাগরিক পরিবেশে এরা স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্য ও সৌন্দর্য হারায়। পরিবেশের সঙ্গে হয় বেমানান। শিশুর সৌন্দর্যও সর্বাধিক মহিমা পায় মায়ের কালে। মায়ের কোল শিশুর নিরাপদ ও স্বস্তিময় আশ্রয়। শিশু যখন মাতৃসান্নিধ্যে স্নেহ গ্রহণ করে তখন তার উৎফুল্ল মুখচ্ছবি, তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রসন্নতা এক অনুপম সৌন্দর্য হয়ে দেখা দেয়। মায়ের কোল থেকে শিশুকে বিচ্ছিন্ন করা হলে সে কেবল সৌন্দর্য হারায় না, বরং নিরাপদ আশ্রয়চ্যুত হওয়ার শংকা ও অনিশ্চয়তায় তার মুখে বেদনার ছাপ পড়ে। এমনিভাবে স্বাভাবিক জীবন পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে প্রতিটি প্রাণীই তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারায়। জীবনের সঙ্গে পরিবেশের যোগ যেমন অবিচ্ছিন্ন তেমনি স্ব-স্ব পরিবেশের পটভূমিতেই জীবসত্তা পায় স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও অনুপম বৌশিষ্ট্য। তা না হলে কেবল অসঙ্গতি ঘটে না, অনেক সময় তা দৃষ্টিকটু হয়ে ওঠে।
জীবে প্রেম করে যেই জন
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর
মহাবিশ্বে যা কিছু রয়েছে সবই স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন পরম যত্নে, যেমন পরম ভালোবাসায় সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তাঁর মহাশক্তির ক্ষুদ্রাংশ শক্তি জীবজগতের প্রত্যেকের মধ্যে বিরাজমান। কাজেই জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা আমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য। কেননা জীবসেবা করলেই প্রকারান্তরে স্রষ্টার সেবা করা হয়। জীবের প্রতি যত্নবান হলে বা জীবকে ভালোবাসলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা হয়। এ জন্যেই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন- “জীবে প্রেম করে যেই জন / সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”
সংসারের সবকিছুর স্পর্শে থেকেই ঈশ্বরের আরাধনা করা যায়। লোকচক্ষুর অন্তরালে ধ্যানমগ্ন হলেই সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ করা যায় না। স্রষ্টা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন মানবীয় গুণাবলি দিয়ে, জ্ঞান ও বিবেক বুদ্ধি দিয়ে। যে কারণে জীবজগতের মধ্যে মানুষ সেরা। কাজেই সেরা হিসেবে মানুষের প্রতি যেমন মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তেমনি প্রতিটি জীবের প্রতিও রয়েছে সমান দায়িত্ব ও কর্তব্য। জীব সেবা না করে শুধু ঈশ্বর সেবায় মগ্ন হলে প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের সন্তুষ্টি লাভ করা যায় না। কথাটা বর্তমান পৃথিবীতে অধিকতর প্রণিধানযোগ্য। উদ্ভিদ ও জীবজগৎ ধ্বংস করার ফলে পার্থিব পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। আর তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে মানুষকেই। জীবন ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। মানুষ তার মানবতাবোধের সক্রিয়তায় অসাম্য, বিভেদ, লোভ, হিংসা দূর করার পরিবর্তে নিজেই হয়ে উঠছে লোভী, স্বার্থপর, হিংস্র। তাই জীবকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করলে, জীবের প্রতি অমানবিক হলে ঈশ্বরকেই অবজ্ঞা করা হয়- এই বোধ আমাদেরকে লালন ও পালন করতে হবে। আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে জীবসেবায়, জীবকে ভালোবাসায়।
পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না
পরের জন্য জীবন উত্সর্গ করার মধ্যেই রয়েছে মানবজীবনের সার্থকতা। মানুষের জীবন ফুলের মত। পুষ্প আপন সৌন্দর্য নিয়েই বিকশিত হয়, কিন্তু এই সৌন্দর্য ও মাধুর্য পুষ্প স্বীয় স্বার্থে ব্যয় করেনা। বরং অন্যের হূদয় বৃত্তিতে মধুচক্রের প্লাবন ঘটিয়ে সে সার্থক হয়। পুষ্প যেন মানবব্রতী জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ সমাজসত্তার সাথে কেবল যে জড়িত তা নয়, সমাজসত্তার বিকাশের মধ্য দিয়েই ব্যক্তি জীবনের সার্থকতা। সামাজিক কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মধ্যেই আছে পরম সুখ ও পরিতৃপ্তি। পুষ্প তার পবিত্রতা ও তৃপ্তির নৈবেদ্য সাজিয়ে নিজেকে উজার করে দেয় সকলের মাঝে। পুষ্পের সৌরভ ও সৌন্দর্য সকলকে মোহিত করে। আর সেই সৌরভ ও সৌন্দর্য অপরের জন্য বিলিয়ে পুষ্প তার জীবনকে সার্থক করে তোলে। মানুষের চারিত্রিক মাধুর্যও হওয়া উচিত পুষ্পের মতই সুন্দর, সুরভিত, পবিত্র ও নির্মল। পুষ্পের মতই তা নিবেদিত হওয়া উচিত পরের জন্যে। সমাজের জন্যে। জগতের মহত্, সাধু ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা অন্যের মঙ্গলে নিজের জীবন অবলীলায় উত্সর্গ করতে ব্যাকুল। তাঁরা ফুলের মতই নিজের সর্বস্ব মানব কল্যাণে বিলিয়ে দিয়ে তৃপ্তি লাভ করেন। মানুষ শুধু ভোগ-বিলাস ও স্বার্থের জন্যেই জন্ম নেয় নি। মনুষ্যত্বের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে পরের জন্য ভাবতে হয়। পরের কল্যাণ সাধনই মহত্ত্বের লক্ষণ। প্রতিটি মানুষ যদি পরের কল্যাণ ও আনন্দ দানের জন্য কাজ করে তাহলে উন্নত ও আদর্শ সমাজ গড়ে উঠতে পারে। কেননা প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও ব্যক্তি স্বার্থ পরিহারের মাধ্যমেই সমাজ সুন্দর ও সার্থক হয়ে উঠে। সব মানুষ যেদিন ফুলের আদর্শ ভেবে পরের কল্যাণে জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারবে সেদিনই সমাজ জীবনে দুঃখ, যন্ত্রণা, বৈষম্যের অবসান ঘটবে। মানুষের জীবন হয়ে উঠবে আনন্দঘন ও কল্যাণময়। পরার্থে জীবন উত্সর্গ করতে পারলে, মানুষের জীবনও পুষ্পের মত সুন্দর ও সৌরভময় হয়ে উঠতে পারে।
0 comments:
Post a Comment