Monday, 23 September 2019

ভাষা

মানুষ তার মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করার জন্য কণ্ঠধ্বনি এবং হাত, পা, চোখ ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে ইঙ্গিত করে থাকে। কণ্ঠধ্বনির সাহায্যে মানুষ যত বেশি পরিমাণ মনোভাব প্রকাশ করতে পারে, ইঙ্গিতের সাহায্যে ততটা করতে পারে না। ধ্বনিই ভাষার মূল উপাদান। এই ধ্বনির সাহায্যে ভাষার সৃষ্টি হয়। আবার ধ্বনির সৃষ্টি হয় বাগযন্ত্রের দ্বারা। গলনালি, মুখবিবর, কণ্ঠ, জিহ্বা, তালু, দাঁত, নাক ইত্যাদি বাক্ প্রত্যঙ্গকে এক কথায় বলে বাগযন্ত্র। এই বাগযন্ত্রের দ্বারা উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকে ভাষা বলে।

বর্তমান পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারের বেশি ভাষা প্রচলিত আছে। তার মধ্যে ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলা পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ মাতৃভাষা। বাংলাদেশের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাদেশের ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ এবং ত্রিপুরা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের কয়েকটি অঞ্চলের মানুষের ভাষা বাংলা। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের অনেক বাংলা ভাষাভাষী জনগণ রয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে ত্রিশ কোটি লোকের মুখের ভাষা বাংলা।

বাংলা ভাষা রীতি

বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলের জনগণ নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষায় কথা বলে। এগুলো আঞ্চলিক কথ্য ভাষা বা উপভাষা। এ ধরনের আঞ্চলিক ভাষাকে বলার ও লেখার ভাষা হিসেবে সর্বজনীন স্বীকৃতি দেওয়া সুবিধাজনক নয়। কারণ, তাতে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাভাষীদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানে অন্তরায় দেখা দিতে পারে। সে কারণে, দেশের শিক্ষিত ও পণ্ডিত সমাজ একটি আদর্শ ভাষা ব্যবহার করেন। বাংলা ভাষাভাষী শিক্ষিত জনগণ এ আদর্শ ভাষাতেই পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা  ভাবের আদান-প্রদান করে থাকেন। শিষ্টজনের ব্যবহৃত এ ভাষাই আদর্শ চলিত ভাষা।

ভাষার মৌখিক রূপের আবার রয়েছে একাধিক রীতিঃ একটি চলিত কথ্য রীতি অপরটি আঞ্চলিক কথ্য রীতি। বাংলা ভাষার লৈখিক বা লেখ্য রূপেরও রয়েছে দুটি রীতিঃ একটি চলিত রীতি অপরটি সাধু রীতি। 

সাধু ও চলিত রীতির পারথক্যঃ

১। সাধু রীতি
(ক) বাংলা লেখ্য সাধু রীতি  সুনির্ধারিত ব্যাকরনের নিয়ম অনুসরণ করে চলে এবং এর পদবিন্যাস সুনিয়িন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট।
(খ) এ রীতি গুরুগম্ভীর ও তৎসম শব্দবহুল।
(গ) সাধু রীতি নাটকের সংলাপ ও বক্তৃতার অনুপযোগী।
(ঘ) এ রীতিতে সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ এক বিশেষ গঠনপদ্ধতি মেনে চলে।

২। চলিত রীতি  
(ক) চলিত রীতি পরিবর্তনশীল।
(খ) এ রীতি তদ্ভব শব্দবহুল।
(গ) চলিত রীতি সং ক্ষিপ্ত ও সহজবোধ্য এবং বক্তৃতা, আলাপ-আলোচনা ও নাট্যসংলাপের বেশি উপযোগী।
(ঘ) চলিত রীতিতে সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ পরিবর্তিত ও সহজতর রূপ যেলাভ করে।

৩। আঞ্চলিক কথ্য রীতি
সব ভাষারই আঞ্চলিক রূপের বৈচিত্র থাকে, বাংলা ভাষারও তা আছে। বিভিন্ন অঞ্চলের কথিত রীতির বিভিন্নতা লক্ষিত হয়। আবার কোথাও কোথাও কারো কারো উচ্চারণে বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার মিশ্রণও লক্ষ্য করা যায়।

বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার
বাংলা ভাষায় যে শব্দভাণ্ডারের সমাবেশ হয়েছে, সেগুলোকে পণ্ডিতগণ কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন-
১। তৎসম শব্দ           ২। তদ্ভব শব্দ           ৩। অর্ধ-তৎসম শব্দ           ৪। দেশি শব্দ  
৫। বিদেশি শব্দ    

তৎসম শব্দঃ যেসব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে সোজাসুজি বাংলায় এসেছে এবং যাদের রূপ অপরিবর্তিত রয়েছে, সেসব শব্দকে বলা হয় তৎসম শব্দ। তৎসম একটি পারিভাষিক শব্দ। এর অর্থ [তৎ (তার) + সম (সমান)] তার সমান অর্থাৎ সংস্কৃত। উদাহরণ - চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, ধর্ম, পাত্র, মনুষ্য ইত্যাদি।

তদ্ভব শব্দঃ যেসব শব্দের মূল সংস্কৃত ভাষায় পাওয়া যায়, কিন্তু ভাষার স্বাভাবিক বিবর্তন ধারায় প্রাকৃতের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে, সেসব শব্দকে বলা হয় তদ্ভব শব্দ। তদ্ভব একটি পারিভাষিক শব্দ। এর অর্থ, তৎ (তার) থেকে ভব (উৎপন্ন)। যেমনঃ সংস্কৃত - হস্ত, তদ্ভব - হাত। এই তদ্ভব শব্দগুলোকে খাঁটি বাংলা শব্দও বলা হয়।  

অর্ধ-তৎসম শব্দঃ বাংলা ভাষায় কিছু সংস্কৃত শব্দ কিঞ্চিত পরিবর্তিত আকারে ব্যবহৃত হয়। এগুলোকে বলে অর্ধ-তৎসম শব্দ। অর্ধ-তৎসম মানে আধা সংস্কৃত। উদাহরণ - গিন্নী, কুচ্ছিত ইত্যাদি।

 দেশি শব্দঃ বাংলা ভাষাভাষী আদিম অধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতির কিছু কিছু উপাদান বাংলায় রক্ষিত রয়েছে। এসব শব্দকে দেশি শব্দ নামে অভিহিত করা হয়। অনেক সময় এসব শব্দের মূল নির্ধারণ করা যায় না ; কিন্তু কোন ভাষা থেকে এসেছে তার হদিস মেলে। যেমনঃ পেট (উদর) - তামিল ভাষা, চুলা (উনুন) - মুন্ডারী ভাষা। 

 
বিদেশি শব্দঃ রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সংস্কৃতিগত ও বানিজ্যিক কারণে আগত বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বহু শব্দ বাংলায় এসে স্থান করে নিয়েছে। এসব শব্দকে বলা হয় বিদেশি শব্দ। এসব বিদেশি শব্দের মধ্যে আরবি, ফারসি ও ইংরেজি শব্দই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া পর্তুগিজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, তুর্কি - এসব ভাষারও কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় এসে গেছে। 

আরবি শব্দঃ 
১। ধর্ম সংক্রান্ত শব্দ - ইসলাম, কোরবানি, হারাম ইত্যাদি।
২। প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক শব্দ - আদালত, ইনসান, উকিল, কানুন, কলম, কিতাব, কেচ্ছা, গায়েব, দোয়াত, নগদ, বাকি, মহকুমা, রায় ইত্যাদি।

ফারসি শব্দঃ
১। ধর্ম সংক্রান্ত শব্দ -  খোদা, গুনাহ, নামাজ, রোজা ইত্যাদি।
 ২। প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক শব্দ - কারখানা, চশমা, তারিখ, দফতর, দরবার, দোকান, দস্তখত, নালিশ, ইত্যাদি।
২। বিবিধ - আদমি, আমদানি, জানোয়ার, নমুনা, বদমাশ, রফতানি, হাঙ্গামা ইত্যাদি।

ইংরেজি শব্দঃ 
ইউনিভার্সিটি, কলেজ, টিম, নভেল, নোট, পাউডার, পেন্সিল, ব্যাগ, ফুটবল, মাস্টার, স্কুল, আফিম (উচ্চারণ পরিবর্তনে), অফিস, বাক্স  (উচ্চারণ পরিবর্তনে), হাসপাতাল (উচ্চারণ পরিবর্তনে), বোতল
(উচ্চারণ পরিবর্তনে), ইত্যাদি।

পর্তুগিজ শব্দঃ আনারস, আলপিন, আলমারি, গির্জা, গুদাম, চাবি, পাউরুটি, বালতি ইত্যাদি।
ফরাসি শব্দঃ কার্তুজ, কুপন, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি।
ওলন্দাজ শব্দঃ টেক্কা, তুরুপ, হরতন ইত্যাদি।
গুজরাতি শব্দঃ খদ্দর, হরতাল ইত্যাদি।
পাঞ্জাবি শব্দঃ চাহিদা, শিখ ইত্যাদি।
তুর্কি শব্দঃ চাকর, চাকু, তোপ, দারোগা ইত্যাদি।
চিনা শব্দঃ চা, চিনি ইত্যাদি।
মায়ানমার (বার্মিজ) শব্দঃ লুঙ্গি, ফুঙ্গি ইত্যাদি।
জাপানি শব্দঃ রিক্সা, হারিকিরি ইত্যাদি।

মিশ্র শব্দঃ কোনো কোনো  সময় দেশি ও বিদেশি শব্দের মিলনে শব্দদ্বৈত সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমনঃ
রাজা-বাদশাহ (ততসম+ফারসি), হাত-বাজার (বানলা+ফারসি), হেড-পণ্ডিত (ইংরেজি+তৎসম), চউ-হদ্দি (ফারসি+আরবি) ইত্যাদি।

পারিভাষিক শব্দঃ বাংলা ভাষায় প্রচলিত বিদেশি শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দকে পারিভাষিক শব্দ বলে। যেমনঃ  অম্লজান (oxygen), উদযান (hydrogen), নথি (file), প্রশিক্ষন (training), বেতার (radio), সচিব (secretary), স্নাতক (graduate), সমাপ্তি (final), সমীকরণ (equation) ইত্যাদি।

Rajesh Konwar

Author & Editor

Has laoreet percipitur ad. Vide interesset in mei, no his legimus verterem. Et nostrum imperdiet appellantur usu, mnesarchum referrentur id vim.

0 comments:

Post a Comment